সারা বিশ্বেই পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর মান কমে যাচ্ছে। কিন্তু দম্পতিদের সন্তান না হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। দম্পতিদের সন্তান না হওয়ার যত ঘটনা ঘটে তার প্রায় অর্ধেকই ঘটে পুরুষের অনুর্বরতার কারণে। গবেষণায় দেখা যায়, দূষণসহ বিভিন্ন কারণ পুরুষের উর্বরতার ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় বীর্যে শুক্রাণুর মানের ওপর। মাত্র ৭০ বছর আগেও পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ২৫০ কোটি। কিন্তু ২০২২ সালে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮০০ কোটি। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন কমে আসছে। বিশ্বজুড়ে শিশু জন্মের হার রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে।
ব্যক্তির সন্তান জন্মদানের শারীরিক সক্ষমতাকে বলা হয় ফিকান্ডিটি। মনে করা হচ্ছে এই ফিকান্ডিটির হার বর্তমানে হয়তো কমে যাচ্ছে। কিছু গবেষণার আভাস, পুরুষদের প্রজনন সমস্যা বাড়ছে। এর মধ্যে আছে বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া, দেহে টেস্টোস্টেরন নামে হরমনের মাত্রা কমে যাওয়া, পুরুষাঙ্গের উত্থানজনিত সমস্যা বেড়ে যাওয়া এবং অন্ডকোষের ক্যানসার।
এখন মনে করা হচ্ছে খুব সামান্য কিছু পরিবর্তনও এই অনন্য বৈশিষ্ট্যধারী কোষগুলোর ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে জোরালো প্রভাব পড়তে পারে তাদের ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার ক্ষমতার ওপর। উর্বরতার জন্য যে জিনিসটি বিশেষ জরুরি তা হলো শুক্রাণুর সচলতা, তাদের আকার ও আকৃতি এবং একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বীর্যের মধ্যে তাদের সংখ্যা। যাকে বলে ‘স্পার্ম কাউন্ট।’
জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাজাই লেভিন বলেন, ‘সাধারণত প্রতি মিলিলিটার বীর্যের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা যদি চার কোটির কম থাকে তখনই উর্বরতার সমস্যা দেখা যেতে থাকে। স্পার্ম কাউন্টের সঙ্গে উর্বরতার সম্ভাবনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। শুক্রাণুর সংখ্যা মিলিলিটার প্রতি ৪০ মিলিয়নের নিচে নেমে গেলেই গর্ভধারণের সম্ভাবনা অনেক খানি কমে যায়। অধ্যাপক লেভিন এবং তার সহযোগীরা ২০২২ সালে পৃথিবীব্যাপী স্পার্ম কাউন্টের নিম্নমুখী প্রবণতা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে স্পার্ম কাউন্ট গড়ে ১.২% কমে গিয়ে মিলিলিটার প্রতি ১০৪ থেকে ৪৯-এ নেমে এসেছে। এর মধ্যে ২০০০ সাল থেকে শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়ার হার বেড়ে বছর প্রতি ২.৬%এ উঠেছে।
এমনও হতে পারে যে শুক্রাণুর মানের এ অবনতি হয়তো ব্যক্তিগতভাবে জীবনযাপনে পরিবর্তন এনেও ঠেকানো সম্ভব নয়। গবেষণা থেকে ক্রমশই এমন আরো বেশি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে এক্ষেত্রে একটি ব্যাপকতর পরিবেশগত হুমকি রয়েছে, আর তা হলো দূষণ সৃষ্টিকারী নানা ক্ষতিকর পদার্থ।
মানুষের ঘরের ভেতরে ব্যবহৃত হয় এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেবেকা ব্ল্যানচার্ড। এজন্য তিনি কাজে লাগাচ্ছেন গৃহপালিত কুকুরকে। রেবেকা গবেষণা করছেন প্লাস্টিক, আগুনরোধী রাসায়নিক এবং ঘরের অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী নিয়ে। এসব রাসায়নিক পদার্থের কিছু কিছু নিষিদ্ধ কিন্তু পরিবেশে এবং পুরোনো জিনিসপত্রের মধ্যে তার অবশেষ রয়ে গেছে। তার গবেষণায় দেখা গেছে, এসব রাসায়নিক পদার্থ আমাদের হরমোন সিস্টেমকে বিঘ্নিত করতে পারে এবং মানুষ ও কুকুর উভয়ের ক্ষেত্রেই উর্বরতা কমিয়ে দিতে পারে।
রেবেকা ব্ল্যানচার্ড বলছেন, ‘আমরা মানুষ এবং কুকুর উভয়েরই শুক্রাণুর নড়াচড়ার ক্ষমতা কমে যাওয়ার তথ্য পেয়েছি। তা ছাড়া তার ডিএনএ ভেঙে যাওয়ার পরিমাণও বেড়ে যেতে দেখেছি।’
ডিএনএ ভেঙে যাওয়া বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন, যেসব জিনগত সামগ্রী দিয়ে শুক্রাণু তৈরি তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা ভেঙে যাওয়া। রেবেকা ব্ল্যানচার্ড বলছেন, ডিএনএ ভেঙে যাওয়ার পরিমাণ যদি বেড়ে যায় তাহলে গর্ভধারণের প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে ‘মিসক্যারেজ’ বা ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বেড়ে যায়।
ওই গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, প্লাস্টিক, সাধারণ নানা ওষুধ, খাদ্য এবং বাতাসে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থ উর্বরতার ক্ষতি ঘটাতে পারে। এগুলো শুধু পুরুষ নয়, নারী ও শিশুদের দেহেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কার্বন এবং কখনোই নষ্ট হয় না এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত গর্ভস্থ শিশুর দেহেও পাওয়া গেছে। বেশ কিছু প্রাণীর ওপর চালানো জরিপে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুক্রাণুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। যে তাপপ্রবাহ কীটপতঙ্গ ও মানুষের শুক্রাণুর ক্ষতি করে। ২০২২ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গরম পরিবেশে বা উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করলে শুক্রাণুর মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।