ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি অন্যতম। এই চিকিৎসা চলাকালীন ক্যান্সার রোগীদের কারো কারো শরীরের সব লোম উঠে যায়। শরীর দুর্বলও হয়ে যায়। কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ওজন কমে শুকিয়ে জীর্ণশীর্ণ হতে হয়। অথচ প্রকৃতিতে এমন একপ্রকার গাছ আছে, যার ফল কেমোথেরাপির চেয়ে ১০ হাজার গুণ শক্তিশালী! এই ফল খেলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। দক্ষিণ আমেরিকার সেই ফলের গাছ এখন বাংলাদেশেও চাষ হচ্ছে। এতে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন হয়তো বাড়বে। তবে এখনো ফলটি সম্পর্কে সেভাবে প্রচার প্রচারণা নেই।
সেই ফলের নাম কী বিষ্ময়কর ফলটির নাম করোসল (corossol)। করোসল অ্যানোনা মিউরিকাটা গোত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধক। ফলটির আরেক নাম ‘সাওয়ার সফ’। করোসলের পাতা অসাধারণ স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। Corossol-কে graviola, soursop গ্র্যাভিওলা, গুয়ানাভা বা ব্রাজিলিয়ান পাও পাও কিংবা টকআতাও বলা হয়ে থাকে।
গুগলে সার্চ করলে অসংখ্য আর্টিকেলস ও গবেষণার তথ্য পাওয়া যাবে এর গুণাগুণ সম্পর্কে। চিকিৎসা বিজ্ঞানিরা এই ফলটি ক্যান্সাররোধে কতটা কার্যকর এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু না বলেও এর বিপক্ষে কেউ বলছেননি। করোসল গাছের পাতার চা নিয়মিত খেয়ে অনেকে উপকৃত হয়েছেন বলে জানা যায়। এই করোসল নিয়ে গবেষণা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মনিরুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, করোসল গাছের পাতাও ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যাসহ নানাধরনের রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি নিজেও নিয়মিত করোসল পাতার চা পান করেন।
তার মতে, ক্যান্সার নির্মূলে করোসল ফলের চেয়েও পাতা বেশি কার্যকর। এজন্য পাতা দিয়ে চা বানিয়ে নিয়মিত খেতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ড. মনিরুল ইসলাম জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই গাছের পাতা প্যাকেট করে বিক্রি হয় এবং ক্যাপসুল বানিয়েও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করছে।
কোথায় পাওয়া যায়? ক্যন্সার চিকিৎসার অলটারনেটিভ হিসেবে ব্যবহৃত এই অসাধারণ গাছ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এখন চাষ হচ্ছে। সারাদেশে এই উপকারী গাছ ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষক ড. মনির।
বিভিন্ন সূত্রেপ্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, নীলফামারি, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে করোসলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে নীলফামারির খড়িবাড়ি গ্রামের ফলন শুরু হয়েছে এই গাছের। বিভিন্ন দেশ ঘুরে চারা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তার বাগানে এই গাছ লাগান। সেই গাছে ফলও ধরেছে।
‘রাজশাহীর পণ্য’ নামে একটি ফেসবুক পাতা ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহী থেকে করোসল গাছের কলম বিক্রি হয়। অনলাইনে দেশের যেকোনো স্থান থেকে ৬শ টাকায় একটি করোসল গাছের চারা তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যাচ্ছে। চারা হাতে পেয়ে পেমেন্ট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
নীলফামারির অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আলমাস রাইসুল গনির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার বাড়িতে প্রায় দুই একর জমিতে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা শতাধিক ঔষধি ফলজ গাছ লাগিয়েছেন। এরমধ্যে করোসল গাছটি ২০১১ সালে পশ্চিম আফ্রিকার আইভরিকোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়। তার দেওয়া সূত্র ধরে ওয়েব সাইটে ক্যান্সারের প্রতিষেধক হিসেবে এ ফলের পক্ষে বিশেষজ্ঞদের বহু মতামত পাওয়া যায়।
অনেক দেশেই এ ফলটি ক্যান্সার প্রতিরোধক ফল হিসেবে পরিচিত। প্রায় পাঁচবছর বয়সী ছয়টি গাছের মধ্যে একটি গাছে একটি ফল ফলেছে, যার আনুমানিক ওজন ২৫০ গ্রাম। এছাড়াও ওই বাগানে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক শতাধিক উপকারী গাছ। তিনি শখের বশবর্তী হয়ে বসতভিটায় দুই শতাধিক বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ রোপণ করেছেন।
তার বাগান সঠিকভাবে পরিচর্যার জন্য রেখেছেন দুজন কেয়ারটেকার। বাগানে আবু কদু, কোরঞ্জা, কদবেল, আবুথাম, সানফল, অ্যাগফ্রুট, মেংগ্যাসটিন, চেরি, শফেদা, শরিফা, আলু বোখরা, কদবেল, ফসলা, কমলাসহ ২ শতাধিক ফলের গাছ রয়েছে। ক্যান্সার রোগীদের জন্য সুসংবাদ হচ্ছে, বালু মাটিতে করোসলের ফলন হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে করোসল চাষ করলে ক্যান্সার রোগীদের ক্যামোথ্যারাপির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে না। বর্তমানে কর্নেল সাহেবের বাগানের ২৫০ গ্রাম ওজনের করোসল ফলটির মূল্য ৪৫ হাজার বলে জানা যায়।
কর্নেল আলমাস রাইসুল গনির (অব.) বলেন, সেনাবাহিনীতে চাকরির কারণে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয়েছিল। যে দেশেই যেতাম সেখানেই খুঁজে নিতাম মানবদেহের জন্য উপকারী বৃক্ষ এবং তা সংগ্রহ করে এ বাগান তৈরি করেছি।
নীলফামারীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আফতাব হোসেন জানান, দেশের প্রতিটি নাগরিককে ফলজ বৃক্ষের পাশাপাশি ঔষধি গাছ লাগানোর জন্য সরকারিভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। নিজ উদ্যোগে শতাধিক ঔষধি গাছের পাশাপাশি করোসলের ফলনে কর্নেল আলমাস রাইসুল গনির বাগানটি উত্তরাঞ্চলের মডেল বাগান হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ক্যান্সার রোগ নিরাময়ের জন্য ক্যামোথ্যারাপির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেলে-দোঁআশ মাটিতে বাণিজ্যিকভাবে করোসল চাষে ভালো ফল আসবে।
বিজ্ঞানিরা বলছেন, এই ফলের এতটাই গুণ, এই ফল খেলে ক্যান্সার রোগীর কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না। শরীরও চাঙ্গা থাকে, দুর্বল ভাব আসে না। মূলত, আমাজন নদীর উপত্যকা- দক্ষিণ আমেরিকার দেশসমূহে করোসল প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। শুধু ফলই নয়, এই গাছের ছাল ও পাতায় লিভার সমস্যা, আর্থরাইটিস ও প্রস্টেটের সমস্যায়ও নিরাময় হয়ে যায়।
কীভাবে কাজ করে করোসল? করোসলের ৪ থেকে ৫টি পাতা কুচি কুচি করে কেটে চায়ের মতো করে পান করা যায়। আবার আস্ত পাতা পানিতে ফুটিয়ে চা বানিয়েও পান করা যায়। পাকা ফল ঠাণ্ডা পানিতে সরবত করে খেতে পারেন। আবার কাঁচাও খাওয়া যায়। ফলটি দেখতে কাঠালের মতো হলেও রং সবুজ হয়।
করোসল গাছে রয়েছে, অ্যানোনাসিয়াস অ্যাস্টোজেনিন নামে এক ধরনের যৌগ। এই যৌগ ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়, যা কেমোথেরাপি করে। ফলে ক্যান্সার কোষ আর বাড়তে পারে না। এছাড়া নিয়মিত এই ফল খেতে পারলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়। রক্তকে শোধিত করতেও এই ফলের গুণ অনস্বীকার্য।