বঙ্গবন্ধু রেল সেতু: ৫০টির মধ্যে ৩১টি পিলার ও ৪৯টির মধ্যে ১৫টি স্প্যানের কাজ শেষ

যমুনার নদীর উপর দেশের অন্যতম বৃহৎ মেগা প্রকল্প ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর’ নির্মাণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের দুই প্রান্তে দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে চলছে। সবমিলিয়ে এই প্রল্পের প্রায় ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এর কাজ শেষ হবে বলে প্রকল্প কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

এই রেল সেতু চালু হলে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের ২২টি জেলার সঙ্গে ট্রেন চলাচল সহজ করবে। একই সঙ্গে আন্ত এশিয়া রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ করিডর হিসেবে কাজ করবে। এ রেলসেতু দেশের উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। এছাড়াও রেল সেতুটি উদ্বোধনের পর স্থানীয়দের স্বচ্ছলতা বেড়ে যাবে বলে মনের করছেন স্থানীয়রা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, যমুনার নদীর দুই প্রান্তে বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার দূরে এ সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া প্রকল্পে চুড়ান্ত নকশা প্রণয়নসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি সাত লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) দেশের বৃহত্তর এ রেল সেতু নির্মাণে সাত হাজার ৭২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। প্রথম দফা ডিপিপি সংশোধনের পর সেতুর নির্মাণব্যয় সাত হাজার ৪৭ কোটি টাকা বেড়ে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেল সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। ২০২৪ সালের আগস্টের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

আরও জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরাল ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকসহ প্রায় চার দশমিক ৮০ কিলোমিটার এই রেলসেতুর দুইপাশে ০.০৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ৭ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেণ্ট এবং লুপ ও সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এ মেগা প্রকল্পের মোট বরাদ্দ প্রায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যার মধ্যে ছয় হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা অর্থ ব্যয় হয়েছে। জাপানি আইএইচআই, এসএমসিসি, ওবায়শি করপোরেশন, জেএফই ও টিওএ করপোরেশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান জানান, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করছে। ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এই সেতুর কাজ শেষ হলে এর ওপর দিয়ে ৮৮টি ট্রেন চলাচল করবে। ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলবে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, যমুনা নদীর উপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর কাজ চলছে। শত শত শ্রমিক বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব পালন করছে। কেউ পাইলিং এর কাজ করছে, কেউ স্পেনের কাজ করছে আবার কেউ ঢালাইয়ের কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ৫০টির মধ্যে ৩১টি পিলার ও ৪৯টির মধ্যে ১৫টি স্প্যানের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে ১৬তম স্প্যানের সুপারস্ট্রাকচার কাজ চলছে। এছাড়া বাকি ১৯টি পিলারের বিভিন্ন স্তরের ঢালাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।

সুপারভাইজার নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমরা বর্তমানে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করছি। আমরা সাব কন্ট্রাকের কাজ করলেও এখানে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। এখানে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত। এর আগেও আমি মেঘনা ও গোমতিতে কাজ করেছি। যেভাবে কাজ হচ্ছে তাতে আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ শেষ হবে।

অপর জন মো. রেজাউল করিম বলেন, এখানে কাজ করতে পেরে আমি খুবই সন্তুষ্ট। আমাদের কাজের কোয়ালিটি ও গুনগত মান অত্যান্ত ভাল। নির্ধারিত সময়ের আগে কোয়ালিটি ও নিরাপত্তা মেনে কাজ শেষ করতে পারবো।

ওভার ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সাইড ইঞ্জিনিয়ার মো. রাকিবুল হাসান প্রান্ত বলেন, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অংশে কাজ হচ্ছে। দিন রাত কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাজ দেখে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট। এখনও পর্যন্ত আমাদের কোন শ্রমিক বা কর্মকর্তার মেজর কোন ইঞ্জুরি নেই। আশা করি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে।

স্থানীয় শাজাহান কবির, মো. শফিকুল বলেন, রেল সেতুর এখানে আমাদের জমি ছিল। সেই জমিতে যে ফসল হত তাতে সংসার চলত না। আমরা এক সময় খুব কষ্টে দিন যাপন করছি। আজ এই যমুনার পাড়ে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় সেতুর পাড়ে দোকান করছি। এছাড়াও ইট বালির ব্যবসা আছে। জনপদের জায়গা হওয়াতে কেউ বেকার নেই। বঙ্গবন্ধু রেল সেতু হওয়াতে আমরা খুশি। এখানে বেকারত্ব দূর হবে, পাশাপাশি এই এলাকার উন্নয়ন ঘটবে বলে মনে করেন।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার নলসন্ধ্যা গ্রামের রেজাউল করিম বলেন, আমি গাজীপুর থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ছুটিতে বাড়ি আসার সময় চন্দ্রা ও টাঙ্গাইলে যানজটে ভোগান্তি পোহাতে হয়। স্বাভাবিক সময়ে গাজীপুর থেকে বাসে উল্লাপাড়া আসতে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা লাগে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে রেল পার হতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগে। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটি চালু হলে সর্বোচ্চ দুই ঘন্টায় উল্লাপাড়া আসতে পারবো। এতে আমাদের যাত্রাও নিরাপদ এবং সময় বাঁচবে।

টাঙ্গাইল-২ (ভূয়াপুর-গোপালপুর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য তানবীর হাসান ছোট মনির বলেন, টাঙ্গাইলবাসীর একটা স্বপ্নের প্রজেক্ট ইকোনমিক জোন। এই রেল সেতুর উত্তর পূর্ব পাশে ইকোনমিক জোন হওয়ার জন্য কাজ চলছে। এখানে লাখ লাখ মানুষের কর্মস্থানের জায়গা হবে। এই রেল সেতু নির্মাণ হলে যে কোন জায়গা থেকে সহজেই পন্য পরিবহন সহজ হবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চালের সাথে আমাদের যোগাযোগের রেল সেতু একটি সেতু বন্ধন করে দিবে।

তিনি আরো বলেন, রেল সেতুর মাধ্যমে যাত্রী সেবার মান বাড়বে পাশাপাশি ব্যবসা বানিজ্যও দ্রুত প্রসার ঘটবে। এক সময় এই যমুনা পাড়ের মানুষ কষ্টে দিনপাত যাপন করছে। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় এই এলাকার মানুয়ের স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। দ্রুতগতিতে রেল সেতুর কাজটি হয়ে গেলে এ এলাকার মানুষের স্বচ্ছলতার আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন।

প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, রেল সেতুর কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। রেলসেতুটি নির্মাণে জন্য প্রায় এক হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক দিনরাত কাজ করেছেন। ইতিমধ্যে রেল সেতুর ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রেল সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই কাজ চলমান করছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে।

Leave a Comment