দেশে গত তিন দিন বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা ক্রমে বাড়ছে। দেশের পাঁচ জেলায় তীব্র এবং অন্যান্য জায়গায় মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গরমে নাজেহাল হয়ে পড়ছে মানুষ।
এদিকে গতকাল সোমবার দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, লঘুচাপের কারণেও তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং তাপপ্রবাহের এলাকা বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ অবস্থা চলবে অন্তত আরো দুই দিন (মঙ্গল ও বুধবার)।
\এখন পর্যন্ত চলতি মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গতকাল চুয়াডাঙ্গায় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯.৪ ডিগ্রি
সেলসিয়াস। আগের দিনের তুলনায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। গরমে নিম্ন আয়ের ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের দুর্ভোগই বেশি হচ্ছে। তিন দিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। এ সময় চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা বেড়েছে ৩.৫ ডিগ্রি। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাফিজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তীব্র রোদের কারণে বাইরে কাজ করা যাচ্ছে না। আমাদের মতো দিনমজুর ও শ্রমিকরাই গরমে কাজ করতে গিয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন।’
দিনাজপুরে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সদর উপজেলার ইজি বাইকচালক আব্দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গরমে পাকা রাস্তায় টেকা যাচ্ছে না। রাস্তা থেকে গরম এসে চোখেমুখে লাগছে, শরীরে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, রাজশাহী, নেত্রকোনা, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য জায়গায় মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ চলছে। আজও দেশজুড়ে এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি আজ আরো ঘনীভূত হতে পারে।
তাপমাত্রা বাড়ছে কেন : আবহাওয়া অধিদপ্তরের চলতি মাসের প্রথম আট দিনের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ মাসের শুরুর দিকে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকলেও গত ৩ ও ৪ তারিখের দিকে কিছুটা কমে আসে। এর পর থেকেই আবার ক্রমে বাড়তে থাকে। গত পাঁচ দিনের ব্যবধানে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫.৬ ডিগ্রি ও রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৬.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপমাত্রা বাড়ার এই প্রবণতাকে এই সময়ে স্বাভাবিকই বলছেন আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদরা। তাপমাত্রা বাড়ার কারণগুলো তুলে ধরে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, লঘুচাপের কারণে এখন তাপমাত্রা বাড়ছে। প্রথম দিকে তাপপ্রবাহ বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও এখন এটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে মূলত লঘুচাপের কারণে। এ ছাড়া গত কয়েক দিনে বৃষ্টিপাত কমে আসাও একটি কারণ। লঘুচাপ বা নিম্নচাপ যখন সাগরে থাকে তখন চতুর্দিকের সব মেঘ কেন্দ্রের দিকে চলে আসে। এতে আশপাশের অঞ্চলগুলো মেঘমুক্ত থাকে। ফলে ওই সব অঞ্চলে সূর্যের তাপ বেশি পড়ে ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
এপ্রিল-মের গরম কি অস্বাভাবিক ছিল : এ বছর এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও আবহাওয়াবিদরা এটাকেও অস্বাভাবিক বলছেন না। আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের বেশির ভাগ জায়গাতেই তখন একটা তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল। এরপর দীর্ঘদিন এ রকম অবস্থা আমরা দেখিনি। এ বছর আবার আমরা কিছুটা দেখছি। আবহাওয়ার এ রকম ঘটনা অনেক বছর পর ঘুরেফিরে আসে।’
তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর তাপমাত্রা সামান্য হলেও বেড়েছে। এ রকম উচ্চ তাপমাত্রাকে দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে কি না— এ প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রা অবশ্যই দুর্যোগ।
হাঁসফাঁস জনজীবন : তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। দিনমজুর, শ্রমিক শ্রেণির মানুষ তীব্র তাপের মধ্যেও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। দিনাজপুরে কয়েক দিন ধরে তাপমাত্রা ৩৫ থেকে সাড়ে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। দুর্ভোগে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। তীব্র গরমকে আরো অসহনীয় করে তুলছে ঘন ঘন লোডশেডিং।
দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন শতাধিক অটো ও ইজি বাইকের চালক। তাঁরা বলেন, গরমে আর পারা যাচ্ছে না, তাই ভাড়া মারা বাদ দিয়ে গাছের ছায়ায় বসে আছেন। রোদ আর গরমে কোনোভাবেই টিকে থাকা যাচ্ছে না। এদিকে প্রচণ্ড রোদ ও দাবদাহে বোরো মৌসুমে শ্রমিকসংকট দেখা দিয়েছে।
হাওর, পাহাড় ও চা অধ্যুষিত এলাকা মৌলভীবাজার জেলা গত কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে। গতকাল বিকেল ৩টায় জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরে এ জেলার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৯ ডিগ্রিতে ওঠানামা করছে।
হাইল হাওরের কৃষক তাহির মিয়া ও রফিক মিয়া বলেন, রোদের কারণে জমিতে পানি নেই; যার কারণে সঠিক সময়ে চাষ করতে পারছি না। অতিরিক্ত গরমের কারণে ধানের বীজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের পানি দিয়ে কোনো রকমে ধানের বীজ সংরক্ষণ করছি। যদি দাবদাহ অব্যাহত থাকে তবে অনেক ক্ষতি হবে।
তীব্র গরমে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গরমে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্রমজীবী মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক কর্মী বলেন, গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেড়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক কর্মীও বলেন, তাঁদের ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেড়েছে।
মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে ডায়রিয়া, জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির মতো রোগীর সংখ্যা বেশি। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়, আবার কিছু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে।’
ময়মনসিংহ নগরীতে গরমে ডায়রিয়া রোগী কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শীত মৌসুমে যেখানে ১০/১২ জন রোগী ময়মনসিংহে এসকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিত, সেখানে এখন গড়ে ২২ থেকে ২৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। তবে রোগীদের তেমন ভর্তি থাকতে হচ্ছে না।
দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে এপ্রিল ও মে মাসের বিশ্লেষণ : আবহাওয়া অধিদপ্তর গত ২ মে চলতি মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস ও এপ্রিল মাসের আবহাওয়ার বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। মে মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে তারা জনিয়েছে, চলতি মাসে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ (৪০-৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য জায়গায় এক থেকে দুটি মৃদু (৩৬-৩৭.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা মাঝারি (৩৮-৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি থাকতে পারে। মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও কালবৈশাখীর সম্ভাবনার কথাও জানায় অধিদপ্তর।
এপ্রিল মাসের বিশ্লেষণে বলা হয়, এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ মাসে দেশের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৩৪ মিলিমিটার হলেও এবার গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৫ মিলিমিটার। অর্থাৎ এপ্রিলে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৬.৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তাপপ্রবাহ থাকতে পারে আগামী শনিবার পর্যন্ত : এদিকে তাপপ্রবাহ সম্পর্কে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ তাঁর ফেসবুকে জানান, গত রবিবার থেকে আগামী শনিবার পর্যন্ত আবারও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ অতিক্রম করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও ঢাকা বিভাগের অনেক জেলার ওপর দিয়ে এই তাপপ্রবাহ অতিক্রম করার প্রবল সম্ভাবনা।
এ সময়ে খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও যশোর এবং রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পাবনা জেলায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। এই সপ্তাহে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীতে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা।