ইসলামে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ না হওয়ার কারণ

যদিও ইসলাম দাসপ্রথাকে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি, তবে তা বিলোপে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন সব মানুষের জন্য অভিন্ন মানবিক অধিকার ও মর্যাদা ঘোষণা করা, দাসমুক্ত করাকে ইবাদত ঘোষণা করা, স্বাধীন ব্যক্তিকে দাস বানানো নিষিদ্ধ করা, দাসমুক্তিকে কাফফারা তথা পাপের প্রতিবিধান ঘোষণা করা, দাসমুক্তিকে পরকালীন মুক্তির উপলক্ষ ঘোষণা করা ইত্যাদি।

দাসমুক্তিতে উৎসাহ দান : রাসুলুল্লাহ (সা.) নানাভাবে দাসমুক্তির ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। যেমন আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো দাস মুক্ত করল, আল্লাহ দাসের প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে তাঁর প্রতিটি অঙ্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন। এমনকি লজ্জাস্থানের বিনিময়ে লজ্জাস্থানকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫০৯)

দাসরা কুরাইশদের সমান : মহানবী (সা.) শুধু দাসমুক্তির পথ দেখাননি; বরং তিনি দাসদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। খ্রিস্টান চিন্তাবিদ নাজমি লুক বলেন, ‘(মুসলিম সমাজে) দাস ও হাবশিরা কুরাইশ সরদারদের সমান।’ (মুহাম্মদ : আর-রিসালাতু ওয়ার রাসুল, পৃষ্ঠা ১৮৫)

দাসরা কুরাইশ নেতাদের সমমর্যাদার অধিকারী এ ঘোষণা শুধু মহানবী (সা.) দেননি; বরং তাঁকে সতর্ক করা হয়েছে যেন তিনি সমাজের নেতৃস্থানীয়দের জন্য দাস ও অসহায় মানুষ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে না নেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবে তাদের সংসর্গে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্বান করে তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের থেকে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। তুমি তার আনুগত্য কোরো না, যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ২৮)

দাসমুক্তিতে ইসলামের নীতি : জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যাডম মেতজ বলেন, ‘দাসমুক্তি ইসলামের অনুসৃত নীতিগুলোর একটি। ইসলাম দাসদের কল্যাণের নীতি অনুসরণ করে। যেমন একজন দাস চাইলে নিজের নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে স্বাধীনতা কিনতে পারে। অর্থের বিনিময়ে মুক্তিকামী দাস ও দাসী অর্থোপজার্নের জন্য পৃথকভাবে কাজের অনুমতি পেয়ে থাকে। মৃত্যুর আগে নিজের মালিকানাধীন দাস-দাসীর স্বাধীনতার ব্যাপারে অসিয়ত করাকে ইসলাম প্রশংসনীয় পুণ্যের কাজ মনে করে।’ (আল-হাদারাতুল ইসলামিয়া ফি-কারনির রাবি আল-হিজরি : ১/২৯০)

নিষিদ্ধের ঘোষণা দেয়নি কেন : ইসলাম দাসপ্রথা বিলোপে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি কেন? মিসরীয় লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ মুসআদ ইয়াকুত এর পেছনে চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তা হলো :

১. সুপ্রাচীনকাল থেকে দাসপ্রথা ও দাস ব্যবসা সমগ্র বিশ্বে প্রচলিত ছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এর ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে আকস্মিকভাবে তা নিষিদ্ধ না করে ইসলাম এমন পন্থা অবলম্বন করেছে যেন ধীরে ধীরে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়।

২. তৎকালীন পৃথিবীর সব রাজ্য, সাম্রাজ্য ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দাসপ্রথার বৈধতার ওপর একমত ছিলেন। ফলে ইসলামী রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করলেও সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হতো না।

৩. দাসপ্রথা নিষিদ্ধের সঙ্গে অসহায়, বৃদ্ধ ও দুর্বল দাসদের সামাজিক ও মানবিক সুরক্ষার প্রশ্নও জড়িত ছিল। দাসদের ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক প্রয়োজনে সাধারণত মনিবদের ওপর বর্তায়। ইসলাম দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করলে বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে যেত। তাদের ভেতর এমন বহুসংখ্যক দাস এমন ছিল, যারা নিজের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম ছিল না। ফলে ইসলাম দাসপ্রথা নিষিদ্ধ না করে দাস-দাসীর অধিকার সংরক্ষণে অধিক মনোযোগী হয়েছে। (ইসলামঅনলাইন ডটনেট)

ইসলামের বিরুদ্ধে অপবাদ : আধুনিক সভ্যতার কথিত দাবিদার, যা এক শতাব্দী আগেও দাসব্যবসায় লিপ্ত ছিল তারা দাসপ্রথার ব্যাপারে ইসলামের বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে চায়। তাদের উত্তরে ফরাসি লেখক ভিনসেন্ট মন্টিয়ার লেখেন, ‘তারা দাসত্বের বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়, যা ইসলামে আগে ছিল, পরে ছিল না। যখন ইসলাম প্রসার লাভ করে এবং ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ইসলাম দাসপ্রথা বিলোপের চেষ্টা করেছে; বরং ইসলাম দাসমুক্তিকে বহু পাপের প্রতিবিধান ঘোষণা করেছে। ইসলাম দাসমুক্তিকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও পুণ্যের কাজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। (রিজালুন ওয়া নিসাউন আসলামু, পৃষ্ঠা ২৩১)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন

Leave a Comment