আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারিমে যে নবীর কথা সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন তিনি হচ্ছেন সায়্যিদিনা মুসা আলাইহিস সালাম; যিনি আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। সুরা কাহফে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেখানে মুসা (আ.)-এর ইলমি সফরের কথা আলোচনা করেন। মুসা (আ.) জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে খিজির (আ.)-এর কাছে গমন করেন, সেখানে তাঁদের মধ্যে কিছু কথোপকথন হয়েছে। তাতে আছে অনেক শিক্ষণীয় দৃশ্যপট। আল্লাহ তাআলা তা আমাদের জন্য কোরআনে উল্লেখ করেছেন। সুরা কাহফে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুসা তাকে বললেন, আমি এ উদ্দেশ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি, যে ইলম শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আপনাকে, আমাকে তা থেকে কিছু কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা দেবেন। (অর্থাত্ অনুমতি হলে কয়েক দিন আপনার সঙ্গে থাকি এবং আপনাকে যে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়েছে তার কিছু অংশ অর্জন করি)। (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৬৬)
এখানে মুসা (আ.) আল্লাহর নবী ও শীর্ষস্থানীয় রাসুল হওয়া সত্ত্বেও খিজির (আ.)-এর কাছে সবিনয় প্রার্থনা করেছিলেন যে আমি আপনার থেকে ইলম শেখার জন্য আপনার সাহচর্য কামনা করি। এ থেকে বোঝা গেল যে ছাত্রকে অবশ্যই ওস্তাদের সঙ্গে আদব রক্ষা করতে হবে।
ইমাম রাজি (রহ.) এই আয়াত থেকে চমৎকার কিছু তথ্য বের করেছেন; যা ছাত্র এবং ওস্তাদের জন্য অপরিহার্য।
১. মুসা (আ.) নিজেকে খিজির (আ.)-এর অনুগত বানিয়ে নিয়েছেন। ইলম অন্বেষণ করার জন্য কারো পূর্ণ আনুগত্য করতে হয়, সেটাই এই আয়াতের বার্তা।
২. মুসা (আ.) বিনয়ের সঙ্গে খিজির (আ.)-এর অনুসরণ করার জন্য অনুমতি চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনি কি আমাকে অনুমতি দেবেন’ এটা হচ্ছে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন।
৩. মুসা (আ.) খিজির (আ.)-কে বলেছেন, আপনার কাছে শেখার জন্য আমি আপনার অনুসরণ করব? তিনি এত বড় আলেম হওয়া সত্ত্বেও নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করছেন এবং শিক্ষকের ইলমের ব্যাপারে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
৪. মুসা (আ.) বলেছেন, আল্লাহ আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা থেকে আমাকে শেখাবেন। অর্থাত্ আমি আপনার কাছে আপনার সমকক্ষ হওয়ার জন্য ইলম অর্জনের দাবি করি না, বরং আপনি আপনার জ্ঞান থেকে কিঞ্চিত্ পরিমাণ আমাকে দান করবেন। যেভাবে কোনো ধনী ব্যক্তি দরিদ্রকে তার সম্পদ থেকে সামান্য পরিমাণ দান করে।
৫. এখানে তিনি এটাও বলছেন, আপনি আমাকে যে ইলম শেখাবেন সে ইলম আল্লাহ তাআলাই আপনাকে দান করেছেন। আল্লাহ যেভাবে আপনাকে দান করেছেন সেভাবে আমাকে আপনি শেখাবেন।
৬. সত্য পথের জ্ঞান আহরণের জন্য আল্লাহর কাছেই মুসা (আ.) প্রার্থনা করছেন। এটাও এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইলমের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা লাগে।
৭. মুসা (আ.) বলেছেন, আপনাকে যা শেখানো হয়েছে তা থেকে আমাকে শেখাবেন। অর্থাত্ যেভাবে আল্লাহ তাআলা আপনাকে শিখিয়েছেন, তেমনি আপনিও আমাকে শেখাবেন। যেভাবে আল্লাহ তাআলা আপনাকে ইলম দান করেছেন তেমনি আপনি আমাকে ইলম শিক্ষা দেবেন। তা আল্লাহর দান এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
৮. অনুসরণ বলা হয় অন্যের কাজ অবিকল অনুরূপভাবে করে দেওয়া। এ জন্য একজন ছাত্রের উচিত শিক্ষকের অনুকরণ করে যাওয়া। শিক্ষকের সঙ্গে কোনো ধরনের বাগবিতণ্ডায় না জড়িয়ে তার কথা ও কাজের অনুসরণ করে যাওয়া।
৯. অনুসরণ করার কথা বলেই এ কথা বোঝানো হচ্ছে যে সব ধরনের বিষয় অনুসরণ করব। এমন নয় যে কিছু কাজে অনুসরণ করব আর কিছু কাজ অনুসরণ করব না।
১০. খিজির (আ.) আগে থেকে জেনেছেন তিনি একজন বনি ইসরাঈলের নবী। আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে তাওরাত দ্বারা সম্মানিত করেছেন। তিনি এমন নবী, যিনি আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। তাঁকে বড় ধরনের মোজেজা দ্বারা সম্মানিত করেছেন, এতদসত্ত্বেও এত মর্যাদার অধিকারী হয়েও তিনি হজরত খিজির (আ.)-এর সঙ্গে যে বিনয় প্রদর্শন করেছেন! এর দ্বারা বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য কত বেশি বিনয় প্রয়োজন ও বিনয়ের চাদরে নিজেকে আবৃত করার আবশ্যকতা।
১১. মুসা (আ.) আবেদন জানিয়েছেন, আমি আপনার অনুসরণ করব, যাতে আপনি আমাকে শিক্ষা দান করেন। তাহলে প্রথমেই তার অনুসরণ করা, শিক্ষকের সেবার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা, তারপর দ্বিতীয় স্তরে ইলম জ্ঞান অর্জন করার ধাপ।
১২. মুসা (আ.) বলেছেন, আমি আপনার অনুসরণ করব ইলম শেখার জন্য; শুধুমাত্র ইলম শেখার জন্যই তিনি খিজির (আ.)-এর কাছে গিয়েছিলেন। অন্য কোনো সম্পদ, পদ-পদবি কিছুই উদ্দেশ্য ছিল না। একজন প্রকৃত তালেবে ইলমের এমনেই উদ্দেশ্য থাকা চাই।