বর্তমানে বিশ্ব একটি সংঘাতময় সময় পার করছে। পৃথিবীর নানাভাবে যুদ্ধ ও সংঘাত চলমান। কোথাও সংঘাত চলছে দুই রাষ্ট্রের ভেতর। আবার কোথাও চলছে রাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তিকামী বা বিদ্রোহীদের সংঘাত। প্রায় প্রতিটি সংঘাতমুখর ও যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে নৃশংসতা ও ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ইসলাম সর্বাবস্থায় নৃশংসতা পরিহারের নির্দেশ দেয়। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ন্যায়নীতি অনুসরণ ও মানবাধিকার রক্ষার তাগিদ দেয় ইসলাম; বরং ইসলাম রক্তপাত বন্ধের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে বলে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই। অন্যজন বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২৭)
যুদ্ধ নয়, সন্ধিকে অগ্রাধিকার : ইসলাম যুদ্ধ-সংঘাতের পরিবর্তে শান্তি ও সন্ধিকে অগ্রাধিকার দেয়। সন্ধির সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেলেই কেবল যুদ্ধের অনুমতি দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা সন্ধির প্রতি ঝোঁকে, তবে আপনিও তাতে সাড়া দিন এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৬১)
যুদ্ধের ময়দানে অনুসৃত নীতিমালা
মানবাধিকার রক্ষা ও নৃশংসতা বন্ধে ইসলাম নিম্নোক্ত নীতিমালা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়।
১. প্রতি কদমে আল্লাহকে ভয় করা : ইসলাম যুদ্ধের ময়দানেও প্রতি কদমে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছে। যেন মানুষ কোনো প্রকার সীমালঙ্ঘন না করে। সুলাইমান বিন বুরাইদা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সেনাবাহিনী কিংবা সেনাদলের আমির নিযুক্ত করতেন তখন বিশেষত তাকে আল্লাহকে ভয় করে চলার উপদেশ দিতেন এবং তাঁর সঙ্গী মুসলিমদের প্রতি আদেশ করতেন তারা যেন ভালোভাবে চলে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৪১৪)
২. নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা নয় : যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাতে মহানবী (সা.) নিষেধ করেছেন। বিশেষত নিরাপরাধ নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা যুদ্ধ করার সময় আল্লাহর নাম নেবে, আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং আল্লাহর রাসুলের মিল্লাতের (ধর্মনীতি) ওপর অটল থাকবে। অতি বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর ও নারীদের হত্যা করবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৬১৪
৩. ধর্মগুরুদের হত্যা নয় : ধর্মগুরুরা সমাজের নীতি-নৈতিকতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে চলেন। ফলে আশ্রম ও উপাসনালয়ে অবস্থানকারী ধর্মগুরু ও সাধকদের ইসলাম হত্যা করতে নিষেধ করে। হাদিসে এসেছে, কোনো বাহিনী প্রেরণের আগে মহানবী (সা.) তাদের বলতেন, ‘তোমরা আশ্রমের অধিবাসীদের হত্যা কোরো না।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ২৬৫০)
৪. প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতারণা নয় : ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতারণা করতে নিষেধ করেছে। বিশেষত যখন উভয়পক্ষ কোনো বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমারা যুদ্ধ করে যাও; কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না, ওয়াদা ভঙ্গ কোরো না, গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ কোরো না, লাশ বিকৃত কোরো না এবং শিশুদের হত্যা কোরো না।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৬১৩)
৫. আশ্রয় দিয়ে হত্যা নয় : যুদ্ধের ময়দানে অনেক সময় প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে এবং অপরপক্ষ তাকে আশ্রয় দানে আশ্বস্ত করে। কাউকে আশ্রয়দানের পর তাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছে ইসলাম। রাসুলুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার পর তাকে হত্যা করল সে কিয়ামতের দিন বিশ্বাসঘাতকতার ঝাণ্ডা বয়ে বেড়াবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৬৮৮)
৬. ধ্বংসযজ্ঞ, সম্পদহানি ও প্রাণী হত্যা নয় : ইসলাম রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যুদ্ধের অনুমতি দেয়, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো, সম্পদহানি ও প্রাণী হত্যার অনুমতি দেয় না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহই তাঁর দ্বিনের সাহায্যকারী। সুতরাং তোমরা (যুদ্ধক্ষেত্রে) গনিমতের সম্পদ আত্মসাৎ কোরো না, প্রতারণা কোরো না, কাপুরুষিকতা প্রদর্শন কোরো না, ভূপৃষ্ঠে বিশৃঙ্খল কোরো না, বৃক্ষরাজি ডুবিয়ে দিয়ো না বা ভস্ম কোরো না, পশু হত্যা কোরো না, ফলদ গাছ ধ্বংস কোরো না এবং আনুগত্যের অঙ্গীকার ভঙ্গ কোরো না।’ (সুনানুল কুবরা লিল-বাইহাকি, হাদিস : ১৭৯০৪)
৭. বন্দিকে মানবিক মর্যাদা প্রদান : ইসলাম শুধু শত্রুপক্ষের বন্দিদেরও পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও মৌলিক অধিকার প্রদানের নির্দেশ দেয় না; বরং ইসলাম বন্দিদের জন্য অর্থ ব্যয় করাকে মর্যাদাপূর্ণ দান বলে ঘোষণা করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে।’ (সুরা দাহর, আয়াত : ৮)
৮. লাশের বিকৃতি সাধন নয় : যুদ্ধের ময়দানে প্রাণহানি এড়িয়ে যাওয়াই ইসলামের নীতি। তার পরও যদি প্রতিপক্ষের কেউ নিহত হয়, তবে ইসলাম লাশের পূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দেয়। লাশ বিকৃত করার মতো অসম্মানজনক কাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেয় ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি শাস্তি পাবে : যে ব্যক্তিকে কোনো নবী হত্যা করেছে বা যে কোনো নবীকে হত্যা করেছে, বিভ্রান্তির দিকে পথ প্রদর্শনকারী ও মানুষের লাশ বিকৃতকারী।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৩৮৬৮)
আল্লাহ নৃশংসতার হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করুন। আমিন