হজের হুকুম হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিমের উপর দ্রুত হজ সম্পাদন করা জীবনে একবার ফরয। একবারের বেশি করলে তা নফল হিসাবে গণ্য হবে। তবে হজ বা উমরার মানত করলে তা সম্পাদন করা ফরয হবে। অনুরূপভাবে কেউ নফল হজ বা উমরা পালন শুরু করলে তা পূর্ণ করাও ফরয হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَتِمُّواْ ٱلۡحَجَّ وَٱلۡعُمۡرَةَ لِلَّهِ
‘আর তোমরা আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে হজ ও উমরা পূর্ণ করো।’ [সুরা বাকারাহ, ১৯৬]
হজ ফরয হওয়ার ব্যাপারটি কুরআন, সহিহ হাদিস ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلا وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ
‘আর যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে, তার উপর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য এ ঘরের হজ করা ফরয। কিন্তু যে ব্যক্তি তা মানে না; আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টি জগৎ থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ [সুরা আলি ইমরান, ৯৭]
আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
«بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَحَجِّ الْبَيْتِ وَصَوْمِ رَمَضَانَ»
‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত―১. আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসুল―একথার সাক্ষ্য দেওয়া, ২. সালাত প্রতিষ্ঠা করা, ৩. যাকাত দেওয়া, ৪. হজব্রত পালন করা এবং ৫. রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা।’ [বুখারি, আসসাহিহ : ৮; মুসলিম, আসসাহিহ : ১১৩] প্রসিদ্ধ হাদিসে জিবরিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের পরিচয় বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
«الإِسْلاَمُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِىَ الزَّكَاةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلاً»
‘ইসলাম হলো, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসুল―এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেওয়া, রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা এবং সামর্থ্য থাকলে কাবাঘরের হজ করা। [মুসলিম, আসসাহিহ : ৯৩]
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন,
«أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ فُرِضَ عَلَيْكُمُ الْحَجُّ فَحُجُّوا»
‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের উপর হজ ফরয করা হয়েছে। অতএব, তোমরা হজ করো।’ একব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল! প্রত্যেক বছরই হজ আদায় করা ফরয?’ রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। লোকটি তিনবার একই কথা জিজ্ঞেস করল। এরপর রাসুল (সা.) বললেন,
«لَوْ قُلْتُ نَعَمْ لَوَجَبَتْ وَلَمَا اسْتَطَعْتُمْ»
‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে প্রত্যেক বছর তা ফরয হয়ে যেত এবং তোমরা তা পালন করতে সক্ষম হতে না।’ [মুসলিম, আসসাহিহ : ৩২৫৭]
যার মধ্যে হজ ফরয হওয়ার শর্তসমূহ উপস্থিত থাকবে, তার উপর হজ ফরয হওয়ার ব্যাপারে সকল মুসলিমই একমত।
হজ ও উমরা ফরয হওয়ার শর্তাবলি
হজ ফরয হওয়ার শর্ত ৫টি। ১. মুসলিম হওয়া, ২. বোধশক্তিসম্পন্ন হওয়া, ৩. বালেগ হওয়া, ৪. স্বাধীন হওয়া ও ৫. সামর্থ্যবান হওয়া। প্রতিটি মুসলিম, বোধশক্তিসম্পন্ন, প্রাপ্ত বয়ষ্ক, স্বাধীন এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ ও উমরা ফরয। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত যুক্ত হবে―‘মাহরাম’ থাকা। হজের সফরে তাদের সাথে মাহরাম (যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত জায়েয) পুরুষ থাকতে হবে। এ পর্যায়ে আমরা শর্তগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।
১. মুসলিম হওয়া :
কোন কাফির, মুশরিক, মুলহিদের ওপর হজ বা উমরা ফরয নয়; বরং কাফির অবস্থায় কেউ তা আদায় করলেও শুদ্ধ হবে না। হজের আগে তাদের ওপর কর্তব্য হলো ইমান আনা। ইসলামকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَا مَنَعَهُمْ أَن تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلَّا أَنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ
‘তাদের অর্থব্যয় কবুল না হওয়ার এছাড়া আর কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি কাফির (অবিশ্বাসী)।’ [সুরা আত-তাওবা, আয়াত: ৫৪]
২. বোধশক্তিসম্পন্ন হওয়া :
বোধশক্তিহীন কোনো ব্যক্তির ওপর হজ ও উমরার নির্দেশ নেই। সেজন্য কোনো পাগল হজ বা উমরা আদায় করলেও তা শুদ্ধ হবে না। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
«رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلاَثَةٍ عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ وَعَنِ الصَّبِىِّ حَتَّى يَحْتَلِمَ وَعَنِ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ»
‘তিন শ্রেণির মানুষের উপর থেকে কলম (শরিয়তের বিধান) উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে: ঘুমন্ত ব্যক্তি, ঘুম থেকে জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত। অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ছেলে-মেয়ে, প্রাপ্ত বয়ষ্ক না হওয়া পর্যন্ত এবং পাগল, বিবেক-বুদ্ধি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত।’ [আবু দাউদ, আসসুনান : ৪৪০৩]
৩. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া :
অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকা এবং দাসের উপর হজ-উমরা ওয়াজিব নয়। তবে তারা যদি আদায় করে, তাহলে তা তাদের পক্ষ থেকে শুদ্ধ হবে এবং যারা তাদেরকে হজ ও উমরা করিয়েছে, তারা সাওয়াব প্রাপ্ত হবে। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন,
«رَفَعَتِ امْرَأَةٌ صَبِيًّا لَهَا فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلِهَذَا حَجٌّ قَالَ نَعَمْ وَلَكِ أَجْرٌ»
এক মহিলা তার বাচ্চাকে উঁচু করে ধরে বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল! এর কি হজ হবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! তবে নেকি তুমি পাবে।’ [মুসলিম, আসসাহিহ : ৩২৫৪] তবে তাদের পক্ষ থেকে হজ-উমরা শুদ্ধ হলেও প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়ার পরে সামর্থ্যবান হলে তাদেরকে আবার তা আদায় করতে হবে। [ইবনু আবি শাইবাহ, আলমুসান্নাফ : ১৪৮৭৫]
৪. স্বাধীন হওয়া :
গোলাম বা ক্রীতদাসের উপর হজ ফরয নয়। যেহেতু ক্রীতদাস তার মনিবের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত। মালিক হজ করালে দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর সামর্থ্য থাকলে তাকে আবার হজ আদায় করতে হবে। ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন,
«احْفَظُوا عَنِّي، وَلاَ تَقُولُوا: قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ، أَيُّمَا عَبْدٍ حَجَّ بِهِ أَهْلُهُ، ثُمَّ أُعْتِقَ فَعَلَيْهِ الْحَجُّ»
আমার পক্ষ থেকে তোমরা মুখস্থ করে নাও, এ কথা বলো না যে, এটি ইবনু আব্বাস বলেছেন, (বরং তা হচ্ছে রাসুলেরই নির্দেশনা) ‘কোনো দাসকে তার পরিবার-পরিজন হজ করালে, দাসমুক্তির পর তার উপর আবার তা ওয়াজিব হবে।’ [প্রাগুক্ত]
৫. সামর্থ্যবান হওয়া :
হজ ও উমরার ক্ষেত্রে সামর্থ্যবান বলতে দৈহিক ও আর্থিক উভয় সামর্থ্যকে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلاۚ ﴾
‘আর যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে, তার উপর আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য এ ঘরের হজ করা ফরয।’ [সুরা আলি ইমরান, ৯৭]
অতএব, বার্ধক্যজনিত কারণে অথবা সুস্থ হওয়ার আশা করা যায় না এমন অসুস্থতার কারণে কেউ হজ ও উমরা আদায়ে অপারগ হলে তার উপর হজ আবশ্যক নয়। অনুরূপভাবে শারীরিক সামর্থ্য আছে কিন্তু অর্থ নেই এমন ব্যক্তির উপরও হজ-উমরা আবশ্যক নয়। তবে শারীরিকভাবে অপারগ ব্যক্তির নিকটে অর্থ থাকলে তাকে অবশ্যই কারো মাধ্যমে বদলি হজ করিয়ে নিতে হবে।
কেউ আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও শারিরিক বা অন্য কোনো কারণে যদি হজ করতে না পারে, তাহলে কাউকে দিয়ে নিজের বদলি হজ করাতে পারে। হাদিসে এসেছে, আবু রাযিন উকাইলি (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল! আমার পিতা বৃদ্ধ মানুষ। তিনি হজ, উমরা বা সফর কোনটিই করতে সক্ষম নয়।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ এবং উমরা আদায় করো।’ [তিরমিযি, আসসুনান, ১/১১২]
ফাযল ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, বিদায় হজের বছর খাসয়াম গোত্রের এক মহিলা এসে বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল! আমার বৃদ্ধ পিতার উপর হজ ফরয হয়েছে; কিন্তু তিনি সফর করতে সক্ষম নন। এক্ষণে তাঁর পক্ষ থেকে আমি হজ আদায় করে দিলে কি তা তার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।’ [বুখারি, আসসাহিহ : ১৮৫৪; মুসলিম, আসসাহিহ : ৩২৫২]
উল্লেখ্য যে, বদলি হজ বা উমরা আদায়কারীকে আগে নিজের পক্ষ থেকে তা আদায় করতে হবে। কারণ হাদিসে এসেছে―ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে ইহরামের কাপড় পরিধানের সময় لَبَّيْكَ عَنْ شُبْرُمَةَ ‘শুবরুমার পক্ষ থেকে লাব্বাইক’ এভাবে বলতে শুনলেন। তো রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শুবরুমা কে?’ সে বলল, ‘আমার ভাই (বা বলল, আমার এক আত্মীয়)। রাসুলুল্লাহ (সা.) লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি নিজের হজ আদায় করেছ?’ সে বলল, ‘না।’ তখন রাসুল (সা.) তাকে বললেন, ‘আগে তো তোমার নিজের হজ করো। তারপর শুবরুমার পক্ষ থেকে হজ করতে পারো। [আবু দাউদ, আসসুনান, ১/২৫২]
মহিলাদের জন্য বিশেষ শর্ত :
কোন মহিলার দৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজে তার সাথে মাহরাম পুরুষ না থাকা পর্যন্ত তাকে সামর্থ্যবান গণ্য করা হবে না। রাসুল (সা.) বলেন,
«لَا تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلَّا مَعَ ذِي مَحْرَمٍ وَلَا يَدْخُلُ عَلَيْهَا رَجُلٌ إِلَّا وَمَعَهَا مَحْرَمٌ»
‘মাহরাম পুরুষ ছাড়া কোন মহিলা সফর করবে না। কোন পুরুষ কোন মহিলার নিকটে তার মাহরামের অনুপস্থিতিতে যাবে না।’ এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল! আমি অমুক সৈন্য দলের সাথে যুদ্ধে যেতে চাই, কিন্তু আমার স্ত্রী চাচ্ছে হজে যেতে।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি বরং তোমার স্ত্রীর সাথে হজে যাও।’ [বুখারি, আসসাহিহ : ১৮৬২; মুসলিম, আসসাহিহ : ৩২৭২]
কোন মহিলা মাহরাম ছাড়া হজ করলে তার হজ শুদ্ধ হবে। তবে মাহরাম ছাড়া সফর করার কারণে সে গোনাহগার হবে। কেননা মাহরাম সঙ্গে থাকা হজ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত, হজ শুদ্ধ হওয়ার শর্ত নয়। অবশ্য মক্কাবাসী কোনো মহিলা নিরাপদ ও বিশ্বস্ত যে কোন সফর সঙ্গীর সাথে হজ করতে পারে। কেননা মক্কা থেকে হজ করলে কোনো সফরের প্রয়োজন পড়ে না। অতএব, সেখানে মাহরামেরও কোনো প্রশ্ন আসে না।