মানুষের সাজসজ্জার অন্যতম মাধ্যম হলো অলংকার, যা মানুষের দৈহিক সৌকর্য বৃদ্ধি করে। পৃথিবীর প্রায় সব জাতি অলংকার ব্যবহার করে। হাজার হাজার বছর আগের সভ্যতায় বিভিন্ন অলংকার ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়।
গয়না আভিজাত্যের প্রতীক : ইসলামপূর্ব যুগে অলংকারকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, পবিত্র কোরআনেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে—‘তবে সে নবী হলে তাকে স্বর্ণের বালা দেওয়া হলো না কেন, অথবা তার সঙ্গে দলবদ্ধভাবে ফেরেশতারা এলো না কেন?’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৫৩)
জাতি ও সংস্কৃতিভেদে অলংকারের গড়ন ও প্রকৃতি ভিন্ন হয়ে থাকে। এমনকি যেসব জায়গায় এখনো সভ্যতার ছোঁয়া পৌঁছেনি, সেখানেও মানুষের অলংকার ব্যবহারের প্রচলন লক্ষ করা যায়। যেমন আমাজন বনে বসবাসকারী উপজাতিরা বিভিন্ন প্রাণীর হাড়, দাঁত ইত্যাদি দ্বারা তৈরি অলংকার ব্যবহার করে। আধুনিক সভ্যতায় সোনা ও রুপার অলংকার সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় লোহার তৈরি গয়নার বিশেষ কদর ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে প্লাটিনামের গয়না তৈরিও শুরু হয়।
গয়না যখন ভালোবাসার স্মৃতি : কখনো কখনো গয়না তার ব্যবহারকারীর কারণে অমূল্য হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে মিশে যায় বহু আবেগ, বহু স্মৃতি ও ভালোবাসা। বংশপরম্পরায় তা পরিবারের কাছে ভালোবাসার প্রতীক হয়ে থাকে। এমনটি ঘটেছিল নবীজি (সা.)-এর জীবনেও। বদর যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করলে সেখানে প্রতিপক্ষের অন্য লোকদের সঙ্গে নবীজির কন্যা জয়নব (রা.)-এর স্বামীও বন্দি হন। জয়নব (রা.) তাঁর স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে মা খাদিজা (রা.)-এর দেওয়া উপহারের হারটি পাঠান। হারটি নবীজি (সা.)-এর চোখে পড়তেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে জয়নব (রা.)-এর স্বামীকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। এবং জয়নব (রা.)-এর মায়ের স্মৃতিবিজড়িত হারটিও ফেরত পাঠিয়ে দেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬৯২)
গয়না যখন বিপদের বন্ধু : পৃথিবীর ইতিহাসে বহু রকম মুদ্রা এসেছে, আবার তা হারিয়েও গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের পৃথিবীতে একসময় পেপার কারেন্সিও থাকবে না। বোঝা গেল পেপার কারেন্সি মান হারাতে পারে, তার আবেদন কমতে পারে। কিন্তু গয়না বা সোনার আবেদন দিন দিন বাড়ছে। বিপদের দিনে গয়না ইত্যাদি তা থেকে মুক্তির জন্য বড় মাধ্যম হতে পারে। উপরোক্ত হাদিসেও তার নজির আছে। নবীজির কন্যা তাঁর স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে মায়ের দেওয়া হারটি পাঠিয়েছিলেন। (প্রাগুক্ত)
গয়না যখন নাজাতের মাধ্যম : গয়না কখনো কখনো নাজাতের মাধ্যম হতে পারে। নবীজি (সা.)-এর যুগে নারীরা জাহান্নাম থেকে মুক্তির আশায় নিজেদের গয়না খুলে দান করে দিয়েছিল। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, বিশ্বনবী (সা.) ঈদের দিনে বের হলেন এবং (ঈদের) দুই রাকাত সালাত আদায় করলেন। তার আগে এবং পরে আর কোনো নফল সালাত আদায় করেননি। এরপর তিনি নারীদের কাছে আসেন এবং তাদের সদকা করার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর তারা তাদের হার ও মালা সদকা করতে থাকল। (বুখারি, হাদিস : ৫৮৮১)
গয়নার ঘটনা কেন্দ্র করে বিধান নাজিল : একবার আয়েশা (রা.)-এর একটি গয়না হারানোকে কেন্দ্র করে মদিনার প্রবেশপথ বাইদা নামক স্থানে নবীজির কাফেলা থেমেছিল। পরবর্তী সময়ে ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেল, অজুর পানি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, এটাকে কেন্দ্র করে পবিত্র কোরআনে তায়াম্মুমের বিধান অবতীর্ণ হয়। এরপর উসায়দ ইবনে হুজায়র আয়েশা (রা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, হে আবু বকরের বংশধর! আল্লাহ তাআলা তোমাদের কারণে মানুষের জন্য বরকত অবতীর্ণ করেছেন। মানুষের জন্য তোমরা হলে কল্যাণ আর কল্যাণ। (বুখারি, হাদিস : ৪৬০৮)
গয়নারও জাকাত দিতে হয় : ইসলাম নারীদের সাজসজ্জার উদ্দেশ্যে গয়না সংগ্রহ করাকে নিষিদ্ধ করেনি। তবে গয়না থাকলে প্রত্যেক মুমিনের ওপর তার জাকাত আদায় করা বাধ্যতামূলক। এতে রিজিকের বরকত যেমন বাড়ে, তেমনি সম্পদও আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয় না। অন্যথায় তা জাহান্নামে যাওয়ারও কারণ হতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (রা.) বলেন, আমরা নবী (সা.)-এর স্ত্রী আয়েশা (রা.)-এর কাছে গেলে তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে এসে আমার হাতে রুপার বড় আংটি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন—হে আয়েশা! এটা কী? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উদ্দেশে সাজসজ্জার জন্য আমি এটা বানিয়েছি। তিনি বলেন, তুমি কি এগুলোর জাকাত দাও? আমি বললাম, না, অথবা আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন। তিনি বলেন, তোমাকে (জাহান্নামের) আগুনে নিয়ে যেতে এটাই যথেষ্ট।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৬৫)